ফিচার
ত্যাগের দীপ্তি -আসাদুজ্জামান খান মুকুল

বিশেষ প্রতিনিধি.
সূর্য ওঠে ধীর পায়ে, ঈদুল আজহার প্রথম ভোরের স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর আকাশে। বাতাসে দোলায়িত হয় এক অনন্য ঘ্রাণ—যা সংসারজীবনের ক্লান্তি ভুলিয়ে দিয়ে এনে দেয় এক পবিত্র অনুভব। ঈদুল আজহার এই সকাল কেবল উৎসবের নয়, এটি এক আত্মশুদ্ধির আহ্বান। এক নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের পথরেখা। মুসলিম উম্মাহ এই দিনে স্মরণ করে স্রষ্টার প্রতি গভীর প্রেম ও আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা।
এই দিবসটির শিকড় গাঁথা আছে ইব্রাহিম (আ.)-এর ত্যাগের অনুপম কাহিনিতে। আল্লাহর নির্দেশে পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি দিতে প্রস্তুত হয়ে তিনি উত্তীর্ণ হয়েছিলেন ঈমান ও ত্যাগের এক কঠিন পরীক্ষায়। মহান আল্লাহ তাঁর এই বিশ্বাস ও আনুগত্য কবুল করে পুত্রের পরিবর্তে পাঠিয়েছেন একটি পশু। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তই আজকে কোরবানির প্রতীক। এটি নিছক পশু জবাই নয়, বরং আত্মপ্রবঞ্চনার শিকড় ছিন্ন করে নিঃস্বার্থ আত্মসমর্পণের প্রতীক।
কিন্তু, প্রশ্ন জাগে, আজকের সমাজে এই আত্মীক বার্তাটি কতটুকু আমরা ধারণ করতে পেরেছি ? কোরবানি কি কেবল পশু কেনা, জবাই ও মাংস বণ্টনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? নাকি এর ভেতরে লুকিয়ে আছে আরও গভীর মানবিক আহ্বান?
আধুনিক সমাজে কোরবানি হচ্ছে সামাজিক সমতার এক অনুপম উদাহরণ। ঈদের দিনে ধনী-গরিব, শ্রেণি-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এক হয়ে যান একই মানবিক বন্ধনে। যখন গরিব মানুষের ঘরে পৌঁছে যায় কোরবানির মাংস, তখন সেই হাসিমাখা মুখগুলোয় প্রতিফলিত হয় কোরবানির আসল সৌন্দর্য। পাড়ায় পাড়ায় যখন ভাগকরে নেয় নিজেদের প্রাপ্তি, তখন এই উৎসব ছড়িয়ে পড়ে হৃদয়ে হৃদয়ে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেকেই আজ কোরবানিকে বাহ্যিক আড়ম্বর আর সামাজিক গৌরবের প্রদর্শনীতে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছেন।
উন্নত জাতের বড়সড় পশু ক্রয়, দামি সাজসজ্জা, সামাজিক মিডিয়ায় ছবি পোস্ট করে গৌরব প্রকাশ, এসবের মধ্যে কোথাও যেন হারিয়ে যাচ্ছে কোরবানির প্রকৃত শিক্ষা। অথচ এর মূল কথা হলো অন্তরের অহং ত্যাগ, নিজের ভোগ-বাসনা বিসর্জন দিয়ে অন্যের মুখে হাসি ফোটানো। হজরত ইব্রাহিম (আ.) আমাদের দিয়ে গেছেন এমন এক চেতনাবোধ, যা যুগে যুগে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে প্রবাহিত হয় ।
এই চেতনা শুধুই ধর্মীয় নয়, এটি সর্বজনীন এক মানবিকতা। একটি দিনে আমরা যদি অসহায় দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি, তবে সেখানেই নিহিত থাকে কোরবানি প্রকৃত সফলতা। বিশেষত এমন একটি সময়ে, যখন সমাজে ধনী – গরীবের ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে, তখন এই উৎসব হতে পারে আলোর দিশারী।
এ ছাড়া পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সচেতনতার দিকেও আমাদের ভাবতে হবে । কোরবানির পশু ক্রয়, সংরক্ষণ, জবাই ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় এখন কিছুটা হলেও সচেতনতা বেড়েছে, তা প্রশংসনীয়। তবে আমাদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে, কারণ ধর্মীয় উৎসবের সৌন্দর্য যেন কোনোভাবেই নাগরিক জীবনের জন্য কষ্টকর না হয়। পরিচ্ছন্নতা, পরিবেশ বান্ধবতা ও সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রেখেই আমরা ঈদের সত্যিকারের সৌন্দর্য রক্ষা করতে পারি।
এখনও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঈদের দিন ভিন্নরকম এক আবেগে ভরে ওঠে মানুষের হৃদয়। বাড়ির উঠোনে গরু বাঁধা, সকালবেলা পাঞ্জাবি পরে মসজিদে যাওয়া, ইমাম সাহেবের খুতবা শুনে নামাজ আদায়, পশু জবাই করা—এসব কেবল ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এ যেন এক পারিবারিক ও সামাজিক ঐক্যের এক অনন্য নিদর্শন। যারা প্রবাসে আছেন, তাদের জন্য এই স্মৃতিগুলো আরও আবেগময় হয়ে ওঠে।
শিশুদের চোখে ঈদ মানে এক অনন্য উচ্ছাস। নতুন জামা, পায়ে নতুন জুতো, আর চারপাশে উৎসবের গন্ধ। কিন্তু এই শিশুদের মধ্যেই অনেকে আছে, যারা হয়তো পিতৃ- মাতৃহীন, কিংবা পথশিশু—তাদের মুখেও যদি এই দিনে একটুখানি হাসি ফোটানো যায়, তাহলেই কোরবানির আসল সৌন্দর্য স্পর্শ করে আমাদের হৃদয়কে।
আল কোরআন এই উৎসবের মধ্য দিয়ে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—আল্লাহর নিকট পশুর রক্ত নয়, দরকার আমাদের তাকওয়া বা স্রষ্টাভীতি। কোরআনের ভাষায়: “তাদের মাংস বা রক্ত আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।” অর্থাৎ, বাহ্যিক আয়োজনের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো আমাদের অন্তরের পবিত্রতা ও আল্লাহ ভীতি।
এই শিক্ষা শুধু ঈদের দিনেই নয়, বরং ইহা হৃদয়ে ধারণ করে আমাদের ব্যক্তি জীবন ও সমাজকে সুন্দর করে তোলা । কোরবানির শিক্ষা হোক আত্মসংযমের, ভোগবাদ থেকে মুক্তির। আধুনিক জীবনে যখন সবাই দৌঁড়াচ্ছে নিজস্ব চাহিদার পেছনে, সেখানে এই উৎসব একটি বিরতি স্বরূপ, যেখানে আমরা ভাবি, আমরা কাকে, কিসের জন্য ভালোবাসি? নিজেকে না স্রষ্টাকে? নিজের স্বার্থ না অন্যের কল্যাণকে?
আজকের দুনিয়ায় যখন হিংসা, বৈষম্য, স্বার্থপরতা ছড়িয়ে পড়ছে, তখন কোরবানির ঈদ আমাদের শেখায় নিঃস্বার্থ প্রেম, সহনশীলতা ও পরম ত্যাগের আদর্শ। হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর চোখে জল ছিল না–ছিল ঈমানের অটল বিশ্বাস। তাঁর পুত্রও ছিলেন ত্যাগে অবিচল। এই আখ্যান আমাদের স্মরণ করায়, পরিবার, সমাজ ও মানবজাতির বৃহত্তর কল্যাণেই আত্মত্যাগেই আমাদের প্রকৃত দায়িত্ব।
ঈদুল আজহার আনন্দ তাই কেবল রঙিন জামা বা সুস্বাদু খাবারে সীমাবদ্ধ নয়; এটি এক আত্মজাগরণের উৎসব, একটি চেতনার উৎসব। যা মুসলিম সমাজকে আহ্বান জানায়, সত্য ত্যাগ ও তাকওয়ার প্রতি ফিরে যাওয়ার। হোক প্রতিটি হৃদয়ে হজরত ইব্রাহিম (আঃ) এর নিষ্ঠাবান বিশ্বাস, আর প্রতিটি সংসারে ছড়িয়ে পড়ুক হজরত ইসমাইল (আ.)-এর মতো বিনয় ও আনুগত্য।
কোরবানির পশু হয়তো কিছু সময়ের জন্য আমাদের ঘরে থাকে, কিন্তু তাদের উপস্থিতি যেন স্থায়ী করে দেয় আমাদের হৃদয়ে কৃতজ্ঞতা,মমতা আর সহানুভূতির বোধ। কারণ কোরবানির চেয়ে বড় কোরবানি হলো আমাদের অহংকার, লোভ, হিংসা, প্রতিহিংসাকে ত্যাগ করা। আমরা যদি তা পারি,তবেই এই উৎসব প্রকৃত অর্থে সফল হবে।
এই ঈদ আসুক আত্মাকে স্পর্শ করতে, হৃদয়কে নির্মল করতে, সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে। ঈদ যেন না হয় কেবল আনুষ্ঠানিকতা—বরং হোক আত্মিক উজ্জ্বলতার এক দীপ্ত উৎসব, যেখানে কোরবানির রক্ত নয়, বরং তার শিক্ষা প্রবাহিত হোক আমাদের জীবনের প্রতিটি স্রোতে।