বীরমুক্তিযোদ্ধা আসাদ উল্লাহ সরকার।

সংগৃহীতঃ
বীরমুক্তিযোদ্ধা আসাদ উল্লাহ সরকার পেশায় একজন আইনজীবী। বর্তমানে সুনামগঞ্জ বারে আইন পেশায় নিয়োজিত। একাত্তরের এক যুদ্ধবীর ও যুদ্ধকালীন কমান্ডার। তিনি সাংবাদিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ( এম এ ), ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক ( বি এস সি ) ও ঢাকার সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে আইনশাস্ত্রে স্নাতক ( এল এল বি ) ডিগ্রী অর্জন করেন।
আসাদ উল্লাহ সরকার ঢাকার কে এল জুবিলী হাইস্কুলে পড়াকালীন ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সে সময়ে ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দের সাথে বিভিন্ন সভায় যোগ দেয়া, ছাত্রলীগের স্মরণিকায় কবিতা লেখা ছাত্রসভায় বক্তৃতা দেওয়া সহ তৎকালে ছাত্রদের প্রতিটি আন্দোলনে-সংগ্রামে তিনি ছিলেন অগ্রগামী।
১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী কেন্দ্রীয় ছাত্র জনতার এক সভায় সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ( বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) শেখ মুজিবুর রহমানকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধি দেয়া হয়। ওইদিন ছাত্র জনতার সভায় আসাদ উল্লাহ সরকারও উপস্থিত ছিলেন।
৭০-য়ের নির্বাচনে আসাদ উল্লাহ সরকার ও তাঁর পিতা সাফিজ উদ্দিন সরকার আওয়ামীলীগের পক্ষে কাজ করেন এবং স্থানীয়ভাবে নেতৃত্ব দিয়ে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী আব্দুস সামাদ আজাদ এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আব্দুল হেকিম চৌধুরীর পক্ষে নির্বাচন করেন।
১৯৭২ সালে ১০ মে তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব আব্দুস সামাদ আজাদ মহোদয় এ প্রসঙ্গে তাঁর পিতাকে একটি লিখিত প্রত্যয়নপত্র প্রদান করেন এবং একই সনের ১৪ ফেব্রুয়ারী তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য জনাব আব্দুল হেকিম চৌধুরী মহোদয় আসাদ উল্লাহ সরকারকে অপর একটি প্রত্যয়নপত্র প্রদান করেন ।
১৯৭১ সালের ২ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশব্যাপী হরতালে তিনি ছাত্র জনতার বিভিন্ন মিছিলে – মিটিংয়ে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহন করেন।
এরই সুবাদে আসাদ উল্লাহ সরকার অন্যান্য ছাত্রনেতাদের সাথে ২ মার্চ ঢাকায় হরতাল পালন শেষে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বংগবন্ধুর বাসায় উপস্থিত হন এবং সেদিন ধানমন্ডির বাসায় সরাসরি তিনি বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছেন।
আসাদ উল্লাহ সরকার ৭১-য়ের ৩ মার্চ ছাত্রদের মিছিলে যোগ দিয়ে, পল্টনের সমাবেশে অংশ গ্রহন করেন। এদিনের জনসভায় সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর সম্মতিক্রমে লাল-সবুজের পতাকাকে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি” সংগীতকে জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষনা করেন।
তখন পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষনা করেন।
এই পটভূমিতেই মূলত ৭ ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বিপুল সংখ্যক লোক একত্রিত হয়,পুরো ময়দান পরিণত হয় এক জনসমুদ্রে।
৭১-এ আসাদ উল্লাহ সরকার ছিলেন এক কলেজ পড়ুয়া ছাত্র। ঢাকার রাজপথে আন্দোলন – সংগ্রামের এক তুখোড় ছাত্র নেতা।
ঢাকায় পড়াশুনা করার সুবাদে জাতীয়ভাবে ছাত্রদের বিভিন্ন আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ পান। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তিনি বংগবন্ধুর জনসভায় যোগ দেন।
সেই দিন তিনি বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছে থেকে দেখতে পেয়েছিলেন এবং ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষন সরাসরি শুনার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর।
তাঁর স্মৃতিকথনে উঠে আসে, রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক জনসভায় তিনি সরাসরি উপস্থিত থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষন শুনেছেন।
সেদিন একটি হেলিকপ্টার আকাশ থেকে জনসভাস্থল পর্যবেক্ষণ করার সময় কিছুটা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন, কি জানি কি ঘটে যায়। এমন সংশয়ে একটা ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠার পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত।
৭ মার্চ বিকেল ২ টা ৪০ মিনিটে বংগবন্ধু জনসভায় উপস্থিত হলেন, চারিদিকে লাখো লাখো জনতার মুহুর্মুহু করতালি আর শ্লোগানে শ্লোগনে মুখরিত হয়ে উঠে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান।
ছাত্র-জনতা সেদিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন বংগবন্ধুর ঐতিহাসিক দিক-নির্দেশনামূলক বক্তৃতা শোনার জন্য। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠার পরই জনসভাস্থল যেনো পিনপতন নীরবতায় চলে আসে।
বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠেই তাঁর মুখনিসৃত ঐতিহাসিক ভাষণ শুরু করলেন, তাঁর ভাষণের প্রথম কথাটিই ছিল,
“ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।”
রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত আঠারো মিনিটের ঐতিহাসিক ভাষনটি শ্রবন করে, তখন থেকেই আসাদ উল্লাহ সরকারের মননে দেশ প্রেমের চেতনা জাগ্রত হয়েছিল।
তিনি বুঝতে পারলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মধ্যদিয়ে দেশের দৃশ্যপট পালটে যাবে। পাকিস্তানি শাসকদের শাসন-শোষনের অবসান ঘটাতে অস্র হাতে নিয়ে রণ ময়দানে লড়াই ছাড়া কোনো গতি নাই।
মূলতঃ সেদিন থেকেই তিনি দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃঢ় সংকল্প করেন।
৭ ই মার্চ এই ঐতিহাসিক ভাষণে, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় আসাদ উল্লাহ সরকারের কাছে একথাটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে এবং কার্যতঃ তিনি বংগবন্ধুর ভাষণ থেকেই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।
বিশেষ করে, (২৫শে মার্চ) ক্র্যাক ডাউনের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বংগবন্ধুকে গ্রেফতার করে নির্জন কারাগারে প্রেরন করলে আসাদ উল্লাহ সরকার ঢাকা শহর থেকে পালিয়ে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে তার নিজ এলাকায় চলে আসেন এবং এলাকার মুক্তিকামী মানুষদের সংগঠিত করে তিনি স্থানীয় ভাবে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন।
এমতাবস্থায় স্থানীয় রাজাকার ও পাকিস্তানি দালালদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী লঞ্চযোগে আসাদ উল্লাহ সরকারের বাড়িতে আসে এবং আসাদ উল্লাহ সরকার ও তাঁর পিতাকে হাতেনাতে ধরার চেষ্টা করে।
কিন্তু হাতেনাতে ধরতে না পেরে আসাদ উল্লাহ সরকারের বাড়িঘরের সমস্ত মালামাল লুটপাট করে ও বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। তাছাড়াও, আসাদ উল্লাহ সরকারের সেলিমগঞ্জ বাজারের এবং সাচনা বাজারের দোকানের সব মালপত্র ও টাকাপয়সা লুটপাট করে নিয়ে যায়।